কবি কৃত্তিবাসের বাছাই করা কবিতা

কাঠের পুতুল

এই যে আছি একলা একা ।
কেমন সুখের কেউ জানোনা ।
আসা যাওয়া নিঃসঙ্গ সদা ।
মাঝে শুধু নিছক আনা গোনা ।

একলা আকাশ একলা সুখে ।
হাজার তারা লুকিয়ে তারই বুকে ।
নীলের মাঝে, স্বপন আঁকে ।
লক্ষ ঝড়েও হার মানে না ।

এখন সময় বারুদ মাঝে ।
নিত্য জীবন মরন ফাঁদে ।
জীবন যেথায়, মৃত্যু সেথায় ।
কেই বা অমর একটানা ?

স্মৃতি শুধুই মনে রাখে ।
যখন সবাই হারায় পথের বাঁকে ।
সেই তো কেবল হাতছানি দেয় ।
ভুলে যাওয়ার ভুল বোঝেনা ।

কেমন আজব কাঠের পুতুল ।
নাচছি সুখে এ কূল ও কূল ।
দুঃখের মাঝে সুখের নাচন,
আহাল্লাদে আধখানা!

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ২০২১

অসংখ্য তুমি ৷৷

অনেক খুঁজেছি নামের পরে নাম ৷
রক্তাক্ত বাসর ঘরে, চিরঘুমে ৷
তুমি শুধু অনন্যা, ভৈরবী নও,
তারও পরে তুমি অনিন্দিতা ৷

যে পাখির ঠোঁটে লেগে আছে শরতের শিষ,
শিউলির রং, তুমি সেই পাখি ৷
বুকে তোমার সমুদ্রের কল কল গান ৷
শত নিঃশ্বাস শুঁকে যায় কামনার ঘ্রান ৷

তুমি ছায়া মানবী, বেবাক বৈরাগী ৷
শাপলার মধু মাঝে লজালু কবির,
অজস্র সকাল সাঁঝে, বিভ্রমে
শ্রাবণের জলে ভেজা কবিতা ৷

তুমি হাজার বছরের পৃথিবী ৷
দুচোখে তোমার নীল নীলাকাশ ৷
যার বুকে বজ্রের খেলা আবিরাম,
অসুর বধের সুদীর্ঘ ইতিহাস ৷

তুমি সুখের, কখনও দুঃখের ৷
কখনও মুখর, কখনও মূক ৷
উদার কোন মায়ের আঁচল ৷
দরদে উছলি উছলি যার বুক ৷

অনেক খুঁজেছি নামের পরে নাম ৷
কাব্যে, সাহিত্যে অসংখ্য কবিতা ৷
নির্জন রাতে তারাদের সাথে খুঁজেছি ৷
অধরা আজও সে অনিন্দিতা ৷

কৃত্তিবাস
শিলং, 14 Oct 2018

।। নিয়তি কে ন বাধ্যতে ।।

অসংখ্য পরিভাষা ঘিরে আছে জীবনের মানে ।
কখনও জীবন কমল কানন ।
কখনও সে ঝরে পড়া গোলাপের দল ।

কিছুটা শরীর, মাংস পিন্ড,
কিছুটা সময় মাধুরী মুখর ।
জীবন কখনও সে শুধু নিকোটিন ।
জীবন কারও কাছে শুধু অর্থের প্রাচুর্য ।

মঙ্গলে জীবনের অস্তিত্ব,
চাঁদে জলের খোঁজে যখন স্বভিমান শিরোনাম ।
হটাৎ ভাষাহীন, মূক নীরব জীবন ।

কেমন একটা হিংস্র জোয়ার ।
সারা বিশ্ব জুড়ে জীবনের হাহাকার ।
বাতাসে বাতাসে বীভৎস মৃত্যুর গন্ধ ।

মাঝ খানে বয়ে গেছে প্রায় আধখানা বছর ।
প্রিয়জন, প্রিয় মানুষের আপেক্ষায় এপার ওপার ।
৬ই ৩৪৯ ইন্ডিগো, গৌহাটি থেকে কলকাতা,
জৌলুসহীন ।

সংকীর্ণতা একে অপরে ।
১৬ এফ রাইট সাইড লেফট সিট ।
একটা জড় পদার্থের মত বসে আছি স্ট্রেট ।

বাবা বলতেন ‘নিয়তি কে ন ব্যাধ্যতে’ ।
সত্যিই তাই !
পৃথিবী জুড়ে কৃষ্ণপক্ষ ।
মহামারী নিয়ে গেছে কত প্রাণ ।
বেবস বিশ্ব দেখি দুচোখে ।

কৃত্তিবাস
খেজুরী, ২৭ সেপ্টম্বর ২০২০

।। স্বপ্ন থেকে স্বাধীনতা ।।

…একটা সাগরের মত জলরাশি ।
ওদিকে পাহাড়ের মত দুর্গম রাত্রি ।
নদীরা ছুটে চলেছে পাহাড়টার বুক চিরে সাগরের পানে ।
মোহনায় বসে স্বপ্ন ।

দুর্গম কিছু উঁচু নিচু পথ ।
শিউরে ওঠার মত,
তবুও কিছু আশা ।
কিছুটা অপেক্ষার ।
স্বপ্নের পা দুটো সমুদ্রের কল কল জলে ।
ঝিনুকের আদর মায়ার কোলে ।

মনে হলো,
কিল বিল স্বপ্নের ঠিক পায়ের কাছে–
কিছু মানুষ হাঁটু গেড়ে বসে ।
ওদের পাঁজরে ব্রিটিশ বুটের দাগ ।
কারও ঝাঁজরা করা বুকে বিলেতি বুলেট স্পষ্ট ।
চারিদিকে মরণ যন্ত্রণার চিৎকার ।

তবুও কোথাও স্বপন জেগে ।
কারও মুখে ’৪৭-এর গল্প ।
তাদের কাঁপা কাঁপা স্বর ।
কেমন ঘুম ঘুম দৃশ্যে ওরা দৃশ্য ।
ওরা কারা ?

…তারপর মানুষের উপস্থিতির শব্দে মিলিয়ে গেল ওরা ।
ঠিক বরফ গলা জলের মত ।
মোহনায় বসে থাকা স্বপ্নের গা ঘেঁষে,
হয়তো নদী হয়ে সমুদ্রের জলে ।

কিছুই জানা গেল না ।
কিছুই বোঝার আগে কানে এল পাখির কূজন ।
মাথার ওপরের চাঁদ ও মিলিয়ে গেছে নীল সমুদ্রে ।
বাইরে উপচে পড়ছে অনেক অনেক আলো।
ঝল মলে সবুজের মাঠ ।
এখানেই স্বপ্নের শেষ ।
আহা, কী-যে অদ্ভুত বেঁচে আছি !

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ৩১ সে অক্টোবর ২০২০

।। বাতাসে লাশের গন্ধ ।।

কেমন সব বদলে বদলে যায় ।
ইট, কাঠ, পাথরের সাম্রাজ্যের সাথে সাথে,
পাথর হৃদয়, আগুন মন ।

চারিদিকে আগুনের লেলিহান ।
মানুষই মানুষের ধ্বংস যজ্ঞে মেতে ।
আর্মেনিয়া নয়তো আজারবাইজান ।

চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রক্তের দাগ ।
কোথাও ধংসের উদযাপন, বিজয়ী উচ্ছ্বাস ।
আরও বেশী মত্ত মাতাল ।
বাকী কত খানি আরও হবে প্রাণপাত ।

পড়ে আছে বারুদ মানুষ,
অঢেল অশেষ ধ্বংসাবশেষ ।
টুকরো টুকরো তৈজষ ভাঙা দেয়ালের ইট ।

চকচকে শহর ।
পুড়ে যাওয়া পান্ডু-লিপি ।
ঝলসানো সবুজ বৃক্ষ ।
পাখির পালক ।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু বুদ্ধের হাত,
অসহায় অহিংসার পবিত্র আঙুল ।
মহাত্মা বুঝি গভীর বিশ্রামে ।

এতো কিছুর পরও বিচলিত হননি কেউ ।
ধীরে ধীরে অহিংসা ধুয়ে যাচ্ছে হিংসার ক্ষার জলে !
সারাটা পৃথিবী জুড়ে ।

একটা শীতল হাওয়া চাই চাই ।
একজন কেউ শান্তির বাণী ছড়িয়ে দাও।
কিছু জীবনের সুর বেজে উঠুক আবারও বাঁশুরিতে ।

মধ্যযুগের আদী মৃত মানুষেরা একবার জীবনের মানে খুঁজে পাক ।
শুধু বল মানুষ মানুষের জন্যে ।
প্রশান্তির বাতাসে লাশের গন্ধ আর নয় ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ১ লা নভেম্বর ২০২০

।। রাত্রির কোলে ।।

আজকে শুয়েছিলাম এক খাঁটি তরুনির পাশে ।
চরম সুখের উল্লাসে ।
আমি যেমনই হই,
তরুণীটা খাঁটি হওয়া চাই ।

দুজন শুয়ে আছে রাত্রির কোলে ।
বাহিরের জোৎস্নার তীব্র রুপোলি আলো ।
সাদা বিছানার চাদরে চক চকে সব ।
শুয়ে আছি মানব মানবী ।
আদী আদম ইভের ন্যায় বস্ত্রহীন, লজ্জাহীন ।

ওর সমস্ত শরীর জুড়ে মাদকতা ।
আমার উষ্ণ নিঃশ্বাসে ও কাঁপছে ।
উত্তেজনায়, নাকি চাপা যন্ত্রনায় ?
পরোয়া করিনা ।

আমার লোলুপ চোখ,
ওর শরীর সমস্ত ভাঁজে ভাঁজে,
সুডোল কায়ায়, উথিত্ব উরু, নিতম্বের তিলে তিলে !
যা কিছু আছে সবটাই একান্ত আজ আমার।

ভোর খুব কাছে ।
এবার পৃথিবীর ঘুম ভাঙবে ।
জানলার ওপারে রজনীগন্ধার সারি ।
একটু পরে সূর্যের আলো চুমু দেবে ওদের নরম গালে।

আমি পাশ ফিরলাম,
কোমল স্বরে ডাকলাম তরুণীকে ।
তরুণীটি এবার পাশ ফিরলো ।
ওর সারা শরীর জুড়ে কামানর অজস্র দাঁত।

আমরা রাতের হিসেব নিকেষ শেষ করলাম ।
চতুর্থীর চাঁদটা এখনও আকাশে ।
ঘরের পর্দাগুলো দুলে উঠল বাতাসে,
গেয়ে উঠল পাখির দল ।

আমি অলস শরীর এলিয়ে বিছানাতে শুয়ে ।
তরুণীটি চলল আপন ঠিকানা পানে ।
দিন শেষে সঙ্গী হবে রাত্রি যাপনে ।

সূর্যেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা ঘর জুড়ে ।
আমরা স্থির,
শুধু সূর্যটা আমাদের মাথার ওপর,
যেতে থাকল আলো ছড়াতে ছড়াতে।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ৩ রা নভেম্বর ২০২০

।। দুর্ধর্ষ এক প্রেমিক ।।

অন্তত একটি দিন, কিছুটা সময় দাও ।
উপলক্ষ না হয় লক্ষ ছাড়া হোক ।
কস্তুরী মৃগের মত কিছুটা গায়ের গন্ধ দাও ।

হৃদয়ের ওলি গলী হয়ে আঠারো বসন্ত পেরিয়েছো ।
হোক সে সূর্যগ্রহণের আবছায়ায়-আলোর মত ।
আমার মস্তিষ্কের সমস্ত স্নায়ু নরম আলো গিলে খেতে খেতে উগরে দিচ্ছে কিছু সুর,—–
সম্ভবত প্রেমের গান।

ছায়াহীন হওয়ার আগে,
যেমন পৃথিবী স্বপ্ন দেখে নতুন বৃক্ষের ।
তেমন না হয় কিছুটা আবেগ,
মিথ্যেই না হয় প্রেমের ফাঁদটা বুনো ।

সহমরণের প্রতিশ্রুতির শেষে,
জাগুক না প্রেম নিরবতার চল্লিশ বসন্তে ।
রোমিও স্বর্গ থেকে নেমে এসে বলে দিক—
কি আছে প্রেমে ?

টলমলে স্মৃতিগুলোকে কিছুটা শক্তি দাও ।
কিছুটা অবিশ্বাস থেকে থাক জমে তোমার বুকের পাঁজরে ।
জনবহুল বাজারে বাজারে অসংখ্য মুখোশগুলো বিশ্বাস-অবিশ্বাসে ভরে আছে ।

বুদ্ধিজীবীদের মত একটা মুখোশ বেছে নাও ।
বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী,সংশয়বাদী-
সব রকম স্বাধীনতা ভোগ করে নীরবে হয়ে ওঠ এক দুর্ধর্ষ প্রেমিক ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ২ রা নভেম্বের ২০২০

।। অসহায় ওরা ।।

একটা সমুদ্র ।
আকাশ যার বুকে দিগন্তের নীল রঙ মিশিয়েছে অগাধ প্রেমে ।
জলের শরীরটা প্রশান্তির নীলে নীল ।
কেউ যেন তুলির টানে এঁকেছে এ সমুদ্র ।

খুব ভালো করে দেখো ।
দেখবে জল আছে,
আছে জীব জন্তু আর পাখি ।
তুমি তাকে নিয়ে ভাবতে পারো ।
আঁকতে পারো মনের মতো অন্য একটা ছবি ।

হয়তো খুব প্রাসঙ্গিক একটা ছবি ।
বলতে পারো অনেক কিছু ।
যদি তোমার বলবার স্বাধীনতা থাকে ।
আর যদি সমুদ্র-উফান ছুটে আসে তট-ভূমির দিকে- ?

একটা নদী ।
নদীর জল রক্ত-লাল ।
নৌকাগুলো দুলছে ঢেউ এর তালে তালে ।
মানুষেরা যাচ্ছে ওপার শহরে ।
তারা বৈঠা বেয়ে ঘুরছে চেতনার অন্বেষণে ।
মানবিকতার, সততা আর প্রেমের খোঁজে ।

হটাৎ তারা দেখতে পেল,—-
মানবিকতা, সততা আর প্রেমে
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তীরের কাদায় ।
আর চেতনা !
ধুলি হয়ে উড়ছে ওপার নগরীর আকাশে বাতাসে ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ৫ই নভেম্বর ২০২০

।। শুধু তুমি, তুমি হয়ে ওঠো একবার ।।

অস্তিত্বকে একবার হিসেবী মানুষের মত গুছিয়ে ফেলো ।
প্রতিবাদী হতে শেখো প্রয়োজনে ।
দেখবে আমি ও তোমার কাছা কাছি ।

শব্দটা ছিলো, আছে, থাকবে ।
তুমি শুনলে না শুধু ।
ছিলো তো– বেশ স্পষ্ট,–
হাতুড়ির, নয়তো চাকার কিংবা শুকনো মাটির পরে পরিশ্রমী হাতগুলো টানছে লাঙল ।
কুপিয়ে চলেছে কোদাল,
আদী হতে অনন্তকাল ।
কিংবা নৌকার দাঁড় টেনে কেউ বা কাহারা,
বাউল সুরে মাতোয়ারা ।

তুমি যখন গ্যালারীর ছবিগুলো নিবিষ্ট হয়ে দেখছিলে ।
কিছু ভাবছিলে ।
নেতাজীর সুট বুটে সৌর্য বীর্যের কাহিনী
পড়ছিলে কাব্যময় ক্যাপশনে,
আর ভাবছিলে, ——
ছবিগুলো, না মানুষগুলো, কোনটা প্রধান ?
আমি তখনও তোমাতে ছিলাম ।

তুমি যখন আপন মানুষের দাউ-দাউ চিতার পাশে,
অশ্রু নয়নে ভাসো ।
মধ্য রাতের মরা চাঁদ জেগে থাকে আকাশে ।
আমি তখনও তোমার পাশে থাকি ।

তুমি যখন ইতিহাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনুধাবন করো ।
ঔরঙ্গজেবের ভুল,
অশোকের রক্তপাত কতকিছু ভুল ঠিক খুঁজতে থাকো ।
কিংবা ওদের ভালো মন্দ,
ভাষ্কর্যের আদলে কয়েদ করো ।
আমি অবাক হলেও তোমার পাশেই থাকি ।

তুমি যখন প্রতিবাদী পায়ে হাঁটছিলে ।
পায়ের শব্দে পথগুলো প্রতিবাদের ভাষা হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল ।
আমি তখন ও ছিলাম-
আমি তোমার মধ্যে অনবরত জেগে আছি ।
শুধু তুমি, তুমি হয়ে ওঠো একবার ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ৪ ঠা নভেম্বর ২০২০

।। এলো মেলো বৃষ্টি ।।

ঝির ঝির আকাশ হটাৎ আলো ।
ঝুপ-ঝুপ শব্দ, তবে কি বৃষ্টি এলো ?
অন্ধকার রাত ঘিরে বিদ্যুত ঝলকানী l
জানালার ওপারে বৃষ্টি ভেজা কোন পাখী l
ভেজা পাখনায় ঝড় ঝড় শব্দ ।
সম্ভবত এক পেঁচা ।

লিচুর গাছের পাতায় বৃষ্টি ফোঁটা ঝম ঝম শব্দ করে ঝরে পড়ছে ।
এয়ারপোর্টের টার্মিনাল জুড়ে
উড়োজাহাজের আনাগোনার শব্দ ভেসে আসছে,
থেমে থেমে বৃষ্টি ভিজে ।

ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আঁধার ঘেরা রাত্রি ।
আমার সময়ও থমকে গেছে কী জানি কোন ভাবনায় ।
ভেজা পাখিটাও থেমে থেমে টান দিচ্ছে পাখনায় ।

মস্তিষ্কের সিড়ি ভেঙে ভাবনারা ওঠে নামে,
বৃষ্টির রাত ঘিরে প্রেম জাগে প্রাণে ।
আবছা আলোয় গাছের ছায়া ।
ঝলকানিতে কিছু প্রেতের মতো মুখ ।
বিশ্রী এক সুখ !

বিদ্যুতের তীক্ষ্ণ ধার কেটে ফেলে সকল প্রেমের এহেসাস ।
ভয়ে ভয়ে কাল রাতে আমার দীর্ঘনিশ্বাস !
কেউ না জানুক, তুমি জান,
চমকানো মেঘে কী হাল আমার ।

কড় কড় শব্দে মগজের কাজ গেছে থেমে ।
রাত্রির ঘুম ছুট বিরাম লেগেছে প্রেমে ।
অন্ধকার রাত, বৃষ্টির ছোঁয়া, ছেঁড়া যৌবন ।
প্রেয়সীরও মুখ ভার, এই তো জীবন !

তারপর টুপটাপ বৃষ্টি এক ফোঁটা দু ফোঁটা ।
অন্ধকার কেটে গেছে ।
নৌকার মত একফালি চাঁদ জেগে উঠলো আকাশে ।
ভেজা মাটি গন্ধ বিলায় বাতাসে বাতাসে ।

জীবন দিয়ে জীবন খুঁজে চলা অবিরত ।
জানি আছে ঢের পথ বাকি ।
আজ আর কবিতা নয়,
বৃষ্টি স্নাত চাঁদ ঘিরে রাত্রি নিঝুম ।
আর ও এক সকাল খুঁজে চোখে নামে ঘুম ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ৬ ই নভেম্বর ২০২০

।। ঘুরে দাঁড়ানোর আহবান ।।

চারিদিকে হৈ চৈ ভাঙ-চুর শব্দ ।
মস্ত এক পাহাড় ধ্বংস হযে যাচ্ছে ।
মানুষেরা ঠায় দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় ।
ফুরিয়ে যাচ্ছে সবকিছু একে একে ।
তবে কী আলোহীন হবে একদিন !

এক অনাদৃত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ।
এক অতীত বৃক্ষ লুকোচুরি আলোতে,
অস্পষ্ট ছায়া বিলচ্ছে অপচয়, ——
মনে হলো কোনো স্মৃতি নেই তার ।
বিনাশ, দুষ্টু পাখীর মতো তীব্র ঠোঁটে,
তেড়ে আসছে দিক-ভ্রান্ত মানুষের দিকে ।
আকাশটাও দিন দিন মাথার ওপর নূয়ে পড়ছে ।

স্মরণের দরজায় উঁকি দিচ্ছে ইতিহাসের দিনগুলো ।
মানুষের আন্দোলন, জয়-পরাজয়,
ঘুরে দাঁড়াবার অদম্য সাহস ।
ক্লিবতা, এ কোন রশ্মিহীন আলোক,
তবে কী সব ইতিহাস ?

স্মৃতিরা সব আটকে এক একটি শহরের পতন দৃশ্যে ।
কোন সভ্যতার প্রমাণ নেই ।
আকাশে সূর্য নেই, চাঁদ নেই, নক্ষত্র নেই ।
জল, বাতাস নেই এই গ্রহে ।
প্রাণ নেই এ পৃথিবী জুড়ে ।

জীবন নেই, প্রাণ নেই ।
কেউ কোথাও নেই ।
তবুও তো আছে কিছু ।
আশা আছে আগামীর কাছে ।
ওরা একদিন ঠিক পৌঁছে যাবে,
জল বাতাসের কাছে প্রাণের ঘনিষ্ট দিনে ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ১০ই নভেম্বর ২০২০

।। কী নাম দেবো ? ।।

সময়ের হাত ধরে কত কিছু বদলে গেছে ।
কত স্মৃতিই অতীত,
কত সম্পর্ক অসমাপ্ত ।
তবুও কোথাও মুহূর্ত গুলো টুকরো টুকরো কাহিনীর মত ।
অসমাপ্ত হয়েও জীবন্ত ।
অতীত হলেও প্রানবন্ত ।

তখন আমি উনিশ কী বিশ ।
তুমি ও কেবল বছর খানেকই পিছিয়ে ।
সদ্য যৌবনের ফাগুন আগুন এপার ওপার ।
নতুন এক অনুভূতি জুড়ে নানা রঙের ভিড় ।
কী জানি সে কারে চাই, অজানা সে তারে চাই ।
পরিচয় ছিল নাটকীয় ।

তোমাকে অহঙ্কারী বলতো সবাই ।
বন্ধুরা খুব চেপে ধরে ছিল আমায় ।
যেমন করেই হোক স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে, তোমাকে গানে হারিয়ে প্রথম পুরস্কারটা যেন ছিনিয়ে নিই ।

খুব মনে পড়ে,——
আমার ছিল অন্তিম বছর ।
ফেয়ারঅয়েল আগেই সমাপ্ত ।
অনেক জল্পনার পর এলো সেই দিন ।
আমার জয়, আর তোমার পরাজয় ।

তুমি অনুষ্ঠানের শেষে এগিয়ে এলে আমার দিকে ।
সদ্য জয়ের উদযাপন তখন চরম সীমানায় ।
টোল পড়া গালে, এক গাল হেসে বলেছিলে,—–
সত্যি খুব ভালো গেয়েছো ।
প্রথম পুরস্কার সঠিক তোমারই প্রাপ্য ।

অনেকটা নাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন তোমার কথাগুলো ।
তোমার সহজ সরল ভাষ্যের মাঝে,
অহঙ্কারের বিন্দু মাত্র লেশ ছিলনা ।
আমি মনে মনে লজ্জিত ছিলাম,
তোমার প্রতি ভুল ভাবনার জন্য ।
আজও শব্দগুলো ধ্বনিত হয় ।
একলা যখন তোমার কথা আমায় ভাবায় ।

তারপর কখন যে ধীরে ধীরে কাছা কাছি ।
দিন ক্ষণ কিছুই টের ছিলনা ।
আমরা বন্ধু হলাম ।
হয়তো তার ও পরে আর ও কিছু ।
একেবারে কাছের, একেবারে নিজের ।
একেবারে অভিন্ন ।

তোমার হোয়তো এতকিছু মনে নেই ।
অথবা থাকার প্রয়োজন বোধই নেই ।
মাটির রাস্তা, বুড়ো বট, মেরুন সাইকেল,
হেঁটে হেঁটে চলা ।
কতক গোধূলী বেলা ।
আর সেই হাসি মুখে রতন দা ?
জানি কিছুই মনে রাখোনি ।

আসলে এসব কিছুর মাঝে,
কেমন আবছা আবছা ছিল সব ।
আমি ভাবতাম তুমি আগে ।
হয়তো তুমিও ভাবতে আমি আগে ।
আমি তুমি, আর তুমি আমি,
গোলক ধাঁধায় অজাও নামহীন ।
শুধু কিছু স্মৃতিই তো থেকে গেছে ।

দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর ।
এতগুলো বছরে কোনদিন সামনা সামনি হলাম না ।
হয়তো তুমি, আমি দুজনেই চাই ও না ।

এখন তুমি কেমন দেখতে হবে ?
খুব সংসারী তাইনা ?
এখন সেই বব কাট ছোট চুল কালো চুল হয়তো নেই ।
কিছু পাকা কাচা,——
আর সেই লাস্যময়ী ?
আমারও চামড়ায় ঢিল পড়েছে ।

অর্ধশতবর্ষ পেরিয়ে আমিও ঘোর সংসারী ।
তবে কলমটা আজও ধরে রেখেছি সমান ভাবে ।
স্মৃতিটা যখন যেমন ভাবায় লিখে ফেলি তোমাকে নিয়ে নিজের মত করে ।

তবে আজ রোমন্থন যেন অনেক কিছুই মনে উগরে দিয়েছে জাবরে ।
অনেকগুলো বছরের পর পুজোতে গেলাম ।
তোমার আমার প্রথম পরিচয় যেখানে শুরু,
সেই স্কুল প্রাঙ্গণের দুর্গাপুজো দেখলাম ।

লাল রাস্তা, জোড়া খেজুর গাছ,
মাটির হোস্টেল, পুকুর ঘাট সব উধাও ।
স্কুল বিল্ডিং, কংক্রিটের হোস্টেল, নতুন গেট, একেবারে নতুন ভাবে সেজেছে ।

আর জীর্ণ পুরনো তোরণ খানা এখন,
অবহেলার অন্ধকারে কোন রকমে দাঁড়িয়ে ।
কতনা প্রেমের সাক্ষী বক্ষে লয়ে ।
আসলে ওটা এখন ব্যাক সাইড ।
কোন যাওয়া আসা নেই ঐ পথে ।
ঠিক যেমন তুমি আমি ।

আমি এক পা এক পা এগিয়ে গেলাম ।
জীর্ণ তোরণ ঘিরে স্মৃতির সম্ভার,
আজ ও আনমনে একাকার ।
তুমি দাঁড়িয়ে আছো পাশিম পাশের পিলার ঘেঁষে !
আমি চমকে উঠলাম ।
এতগুলো বছর পেরিয়ে তুমি ঠায় দাঁড়িয়ে ?

হ্যাঁ শুনেছি শব্দগুলো খুব স্পষ্ট শুনেছি,
তুমি বললে,—-
কেমন আছো ?
হ্যাঁ তারপর তারপর,—-
হাত বাড়িয়ে কিছু একটা খেতে দিলে ।
আমি ভালো আছি কিনা জানিনা ।
সত্যিই কি আজ ভালো আছি ?

তবুও কেমন আছি,——


অনিশ্চিত জীবনের পথে চলতে চলতে ক্লান্ত ।
আমি এখন ছাঁচে ঢালা এক যন্ত্র ।
হৃদপিণ্ডে জার জুড়ে দেওয়া হয়েছে কিছু
শিরা উপশিরা রক্ত সঞ্চালনে, –
বেঁচে আছি শুধু বাঁচার প্রয়োজনে ।
বসন্ত হীন প্রাণ ।
তুখোড় ফাগুন,
আর জ্বালেনাকো তুমুল সে আগুন ।

সম্পর্ক গুলো কেমন বিষিয়ে যাচ্ছে ।
সভ্যতার অশ্লীল বাতাসে।
অবুঝ, মূক, বধির বারান্দকে সঙ্গী করে স্মৃতির রোমন্থন ।
মুমূর্ষ বিকেল ঘিরে বিছোড়ের নির্ঘণ্ট ।
জীবন দিয়ে বুঝেছি,
আসোলে, জীবন মানেই যে ঢালু পথে জলের ন্যায় বয়ে যাওয়া নয় ।

জীবনটা যেন এক উত্তাল সমুদ্র ।
কত নদীর আসা যাওয়া ।
মাঝখানে কিছু মেলা মেশা ।
তারপর অথৈ জলে কূল কিনারা হীন ।

অনেকদিন ধরে একটা যুতসই নাম খুঁজে চলেছি ।
কত মাট ঘাট পথ প্রান্তর পার ।
জীবন সায়াহ্নে সব পরিভাষা দিশে হারা ।
তুমিই বল কী নাম দেবো,
তোমার আমার এই অতীত অসমাপ্ত সম্পর্কের ?

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ৯ ই নভেম্বর ২০২০

।। তবে তাই হোক ।।

আমি তোমার কাছে একটি শুধু সকাল চেয়েছিলাম ।
তুমি দিলে দুষ্টু দুপুর ।
ঝলসানো আদিম শহর ।
তবে তাই হোক, গোধূলির সবটুকু রং তোমায় দিলাম ।

আমি তোমার কাছে চেয়েছিলাম একটু ফাগুন ।
পলাশের লালে রাঙবে এ মন ।
শিমুল পানে চক্ষু মেলে ভরবে নয়ন ।
কৃষ্ণচড়ার আকাশ লালে ঝরবে না হয় ফাগুন আগুন ।

আমি তোমার কাছে একটুখানি শরৎ চেয়েছিলাম ।
তুমি দিলে চৈত্র আমায় ।
চাতকের তাই প্রানটুকু যায় ।
তবে তাই হোক, সূর্যরাঙ্গা শিশির মতি না হয় তোমাকে দিলাম ।

আমার মেঘলা আকাশ, ঝড়ো বাতাস আজ তীর হারালো মাঝি ।
চাঁদ বুঝি তাই লুকিয়েছে মুখ ।
চেনা সুখের ভীষন রকম অসুখ ।
আমি মস্ত বোকা, এমনি রাতে, ধ্রুবতারা তোমায় খুঁজি ।

আমি তোমার কাছে একটু কেবল বৃষ্টি চেয়েছিলাম ।
তুমি দিলে অথৈ শ্রাবন ।
ডুবলো যে তাই সখের আঙন ।
তবে তাই হোক, বৃষ্টি শেষের সুনীল আকাশ তোমাকে দিলাম ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ১১ ই নভেম্বর ২০২০

।। আছে কিছু বাকী ।।

আছে কিছু বাকী ।
এখনও তো ফুরিয়ে যায়নি প্রেম ।
জীবনে রঙ্গিন কিছু রয়েছে অবষেশ,
সিঁদুরের লাল আর আবেগি আকাশ নীল ।

তবে কেন এতটা শূন্যতা ?
আনেক সমবেত অভিমান, অভিযোগ ।
মিলিত হাহাকার,
ধিক ধিক আগুনের লেলীহান ।

অজানা একটা ঝড় ।
গহরে গহরে বহমান, ঝঞ্জার সমান ।
ঘিরেছে আকাশের সবটুকু নীল,
কাজল কালো মেঘে তার ।

অন্দর অন্তরে ঝড় ।
দুঃখ গুলো চৌকাঠ পেরোয়নি আজও ।
মৌসুমির মিথ্যে হাওয়াটুকু,
বয়ে যায় শুধু দালান ঘরের বাহিরে ।

রক্তে জমানো জমাট আভিমান,
শিরা, ধমনীতে বহমান ।
হৃদয়ের ঘর বুঝি ডুবেছে প্লাবনে,
সংকীর্ণ শ্রাবনে ।

অন্তরের সরলতা, তরলতা,
বাষ্পায়িত অযাচিত উত্তাপে ।
ফুগুনের লাল, ঝলসানো আবডাল,
অসময় চৈত্র দহনে ।

রাত চলে গেছে কবে ।
চারখানা লাল চোখ নিদ্রাহীন ।
অগাধ প্রাশ্নের মাঝে,
মৌনতা বেঁচে আছে ।
ভোর, সেও ভাষাহীন ।

আছে কিছু বাকী ।
এখনও তো ফুরিয়ে যায়নি প্রেম ।
জীবনে রঙ্গিন কিছু রয়েছে অবষেশ,
সিঁদুরের লাল আর আবেগি আকাশ নীল ।

কৃত্তিবাস দাস
তাগরতলা, ৩০সে নভেম্বার ২০২০

।। বর্গী এলো দেশে ।।

মুঘল নেই, সাম্রাজ্য নেই,
তবুও রয়েছে মুঘলে-আজম ।
স্বাধীনতা আছে, স্বাধীন নই ।
সবকিছুই করছি হজম !

জমায়েত আছে, আন্দোলন আছে ।
প্রতিবাদ আছে, আছে প্রতিহত সেথায় ।
অন্ন আছে, অন্নদাতারা খালি পেট ও আছে ।
জমাখোরী কবজায় ।

কান্না শুধু চিরকাল ।
শাসন করুক মোঘল কিংবা ফিরিঙ্গী ।
প্রজা আছে, আছে প্রজাতন্ত্রের তাস ।
আর আছে ভোগী, সাধু বেশে কিছু ঢোঙ্গী ।

বুল বুলিরা ও আছে ধান ক্ষেতে ।
কৃষক আজও ফলায় সোনার ফসল ।
রাজার ট্যাঁকে টাঁকশাল গোঁজা ।
বর্গীরা তাই আজও ওঁত পেতে ।

নানান শওয়াল, অগাধ জবাব ।
সবার শুধু আমি আমি রব ।
বোকা কিষাণের মাথায় ঢোকেনা, –
কে কৌরব, কেইবা পাণ্ডব !

চারিদিকে জোরা জুরী,
আকাশচুম্বী বিজ্ঞাপন সমাপন ।
হায়রে কপাল আজ ও, –
“রাজার হস্ত, করে সমস্ত
কাঙালেরই ধন চুরি” ?

মনে পড়ে যায়, ঘুমপাড়ানি সেই গান,
“খোকা ঘূমালো, পাড়া জুড়ালো,
বর্গী এলো দেশে ।
বুল বুলিতে ধান খেয়েছে,
খাজনা দেবো কিসে ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ২০ শে ডিসেম্বর ২০২০

।। ফিরে দেখা সে বসন্ত ।।


আমি যখন তোমার উঠোনে,
তুমি তখন চৌদ্দ বসন্তের কুঁড়ি ।
আমি যখন তোমার দরজায়,
তুমি তখন উনিশ বসন্তের পূর্ণাঙ্গ গোলাপ ।

অছুত পাপড়ি ছিল,
ছিল গোলাপি আলোর ছটা ।
সদ্য ছিল যৌবনের ঘটা ।
আর ছিল একরাশ চাওয়া পাওয়া ।

আমি ছুঁয়ে ছিলাম তোমায় ।
চুরি যাওয়া আলোতে, নানা আছিলায় ।
তুমি ও বিলালে যা ছিল তোমার ।
নিমেষেই, দুজন দুজনার ।

প্রতি দলে দলে,
খুদে ছিলে এক নাম অবহেলে ।
অজান্তে সবার,
ছিল নাম লেখা গোপন সখার ।

অদৃশ্য যে সূতো বেঁধেছে,
তার টান, আজও টান-টান ।
গোপন স্মৃতির সম্ভার,
গোপনে গোপন একাকার ।
আমি কেবলই তার, শুধু তার !

এখন সব বুঝি অতীত ।
আজানা গ্রীষ্মের দাবদাহ,
পুড়ালো সবুজ ছিল যাকিছু ।
প্ত্রহীন শিমুলের ন্যায়,
দাঁড়িয়ে রয়েছি ঠায় !

কিছু মিথ্যে ঝড় ।
আর বৈরাগী হাওয়া,
তুফানি হঠাৎ,
গোলাপের পাপড়িরা ঝরে ঝরে পড়ে,
স্নেহহীন এক বিষণ্ণ দুপুরে ।

আগুন সে তো পোড়ায়,
তবু রয় কিছু তায় অঙ্গার ।
বিরহ পোড়ালে,
থাকেনা কিছুই অবশেষ ।
সবটুকু ছারখার ।

কিছু বাকী গোধূলির ডাক ।
বিরহ বিকেল শেষে যাব নির্ঘাত ।
তারপর ঘন রাতে,
ফিরবো আকাশ তারার সাথে,
পিছু ফেলে এই পথ ঘাট ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ১ লা ডিসেম্বর ২০২০

।। এই তো জীবন ।।

এইতো ছিলে ভীষন আপন ।
ভরসা হাতে হাত আমরণ ।
তবে কেন অশ্রু দিলে বল ?
সয় না যে আর এই দুনয়ন ।

জানি মিথ্যে ছিল সে আকাশ ।
আর নিঃস্ব কিছু ঐ বাতাস ।

তবুও সে নীল মেঘ-বাদল ।
বাতাসে তার আয়না আদল ।
তার খেয়ালে ধন্য জীবন,
তার চাওয়াতেই সুখের মরণ ।

নীড় ছাড়া সে প্রেম পাখি ।
অজুহাতে তবু সন্ধানী আঁখি ।

পুড়তো না হয় স্বপন একদিন ।
পুড়ছে এখন হৃদয় কিছু ।
ব্যর্থ তবু স্বপ্নই জীবন ।
স্মৃতি সদাই সুখের আজীবন ।

এই তো আছি আবার হয়তো নেই ।
এক নিমেষে কবরে ঠাঁই ।

শেষ আসে শেষে একদিন ।
কীবা চাওয়া, আর পাওয়া না পাওয়া ।
পেয়েও ছেড়ে যাওয়া……
জানি এইতো জীবন ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ৫ই জানুয়ারি ২০২১

।। আমি আবারও জেগে উঠি ।।

তুমি পারো সব ।
যে দেশে চার চারটি স্তম্ভ বিপননে ।
যে দেশে কলম বিক্রী হয়,
বিকৃত ইতিহাসও লেখা হয় ।
সে দেশে ক্ষনিকের জন্য তুমি পারো ।

তোমরা আগুনে পুড়ে যেতে দেখো ।
আমি খুঁজি তায় রং ।
তোমরা ঝড়ের মাঝে ধংস দেখো ।
আমি খুঁজে পাই নতুনের আগমন ।
আমি আবারও জেগে উঠি ।

যেখানে আন্দোলন আছে ।
যেখানে প্রতিবাদ আছে ।
আর আছে অগাধ অভিশাপ ।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা পাপ ।
আমি ক্ষমা করি বার বার।
আমি আবারও জেগে উঠি একবার ।

জানি, তুমি আমাকে ইতিহাসে করবে ।
তোমার তিক্ত লেখনীতে লিখবে,
মিথ্যার শব্দ সম্ভারে ।
এ খেলা শুধু আজকের নয় ।
তোমার এ খেলা বারে বারে ।
তবু ও আমি উঠে দাঁড়াবো ।

তুমি আমাকে,
খুব জঘন্য কিছু করতে পারো অনায়াসে ।
তুমি আমাকে,
ফ্রেমে বন্দী করতে পারো এক নিমেষে ।
তোমার দামী গাড়ির,
চাকার তলায় পিষতে পারো,
তোমার হাতে শক্তি আছে ।

শুধু পারবেনা থামাতে,
কারন তোমার উৎস আমি ।
আমি চাইলেই,
ধংস আসতে পারে তোমার সাম্রাজ্যে ।

আমি চাঁদের মত আছি ।


আমি সূর্যের মত আছি ।
আমি আছি ঠিক,
জোয়ার- ভাটার নিশ্চয়তার মত সত্য ।
তুমি পারো না, পারবেও না আটকাতে ।
আমি ঠিক উঠবো ।
উঠে দাঁড়াবোই নিশ্চিৎ ।

তুমি কি আমাকে ভঙ্গুর দেখতে চাও ?
তুমি আমাকে পঙ্গু দেখতে চাও ?
নত মস্তক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে চাও ?

যে হাত অন্ন বস্ত্র জোগায় ।
যে চোখে তোমার সাম্রাজ্য সফল হয় ।
আমি সেই হাত,
আমি সেই চোখ ।
আমার অশ্রুফোঁটারা ঝরে পড়ছে ।
আমি দুঃখ পেলে কাঁদতে পারি,
এ আমার অহংকার ।

আমার আর্তনাদ তোমাকে দুর্বল করবে ।
বিক্রী কলমগুলো একতৃত হবে ।
প্রসূতি মায়ের জঠরে জন্ম নেমে বিপ্লব ।
তুমি দেখবে,
আমি উঠছি,
আমি উঠছি,
আমি আবারও উঠে দাঁড়িয়েছি ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ২৫ শে ডিসেম্বর ২০২০

।। প্রতিস্পর্ধা বনাম প্রতিষ্ঠা ।।

নিরন্তর প্রতিস্পর্ধা ।
একটি নিরাপদ পৃথিবী ।
কিছু ভয়হীন আশ্রয়স্থল ।
পুষ্পিত সুযোগ সন্ধান ।
একটি বিশ্ব যা স্বাস্থ্যকর ।

হৃদয়ে গভীর ক্ষত বয়ে চলা ।
তথাপি একটু আশা চঞ্চল ।
লালিত পালিত হতে থাকে ।
স্বপন মেয়েটি খেলতে থাকে।

তবে সে প্রতি মুহূর্তেই ভয় পায় ।
দুষ্টু ছায়া থেকে দূরে যেতে চায় ।
বাস্তবতা ঘর ছাড়া ।
বিষ বৃক্ষের ছড়ানো ডাল পালা ।

কখনও মনে হয়,
এই পৃথিবীতে আর বুঝি নয় ।
অস্তিত্বের কিছু জায়গা শূন্য ।
প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যেতে হয় ।

মিথ্যে আদর্শের কারণে,
কত হাত উঠে আসে কণ্ঠ রোধে ।
দমনের আভিলাষে,
যাতনা সে ও একপেশে ।
লড়াইটা লড়তেই হয় ।

তার ঘাড় নুইয়ে আসে ।
নেতিবাচক মানসিকতা আঁকড়ে ধরে ।
পদদলিত হতে চায়,
কখনও সে বেশ অসহায় ।
তবুও লড়তে হয় ।

প্রথম আঙুল ধরে চলতে শেখা ।
কাছের আঙুলগুলো বেশ দূরে মনে হয় ।
তবুও আঙুল ধরতে হয় ।
পথ চলা শেখা হয় ।
লড়তেই হয় ।

ক্ষীণ আশা হারিয়ে যায়,
অনেকের ভিড়ে গুমনাম হয় ।
লড়াইয়ে দৌড়াও ।
নিজেকে রক্ষা কর ।

আমি তার কথা শুনি ।
আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি ।
একটি জয়ের প্রতিশ্রুতি,
অবশেষে পরাজয়ীর হয় পরাজয় ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ১০ ই জানুয়ারী ২০২১

।। দূর্নিবার ।।

এখন ও মানুষ ক্ষেত মজুর ।
এখনও মানুষ সংগ্রাম করে,
এখন ও সে স্বাধীনতা চায়,…..
তাই আমার কলম গর্জায় ।

এখন ও তুমি অগোছালো তরুণী ।
সম্ভ্রম সে তো শেকলে বাঁধুনি ।
এখন ও তো সেই একই পরিচয়,….
তাই আমার কলম গর্জায় ।

ভিটে মাটি, নাকি মাটি সব ভিটে ।
ধীরে ধীরে পিঠ দেওয়ালে ঠেখেছে ।
বিদ্রোহ আজ মজ্জায়,…..
তাই আমার কলম গর্জায় ।

এখন ও যদি আমি অমানুষ ।
তুমি ও কী কম বুনো মানুষ ?
হিসেবে হিসেবে মিলায়, …..
তাই আমার কলম গর্জায় ।

নিকোটিন আর নয়, জীবন চাই।
ধার নয় আর, অধিকার চাই ।
শেষ হোক সব অন্যায়,…..
তাই আমার কলম গর্জায় ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ২০ এপ্রিল ২০২১

।। স্তব্ধ শঙ্খনাদ ।।

চলে গেছে সে দুরাকাশে ।
বসত এখন তারাদের দেশে ।
বন্ধ আজ, প্রখর-শান্ত সে দুনয়ন ।
দেখবে না আর এমন উন্নয়ন ।

পায়ের ছাপগুলো এখন ও স্পষ্ট ।
সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম পায়ে পায়ে,-
নীরবে, শুধু শব্দ বুনন ছন্দে ।
বাবর ছেড়েছে কবর ।
করজোড়ে শোনায় লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের খবর ।

নিমেষেই, তুমি নেই ?
হতভাগ্য বাংলা হারিয়েছে তার ভাষা ।
স্মৃতি থেকে অস্মৃতিপর ।
হে মহামানব রবেই রবে অমর ।

এ যে তোমারই শব্দ বিষাদ ।
“চোখের কোণে এই সমুহ পরাভব
বিষায় ফুসফুস ধমনী শিরা!”
সত্যি করেই স্তব্ধ শঙ্খনাদ !

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ২২ শে এপ্রিল ২০২০

।। খোলা চোখে স্বপন ।।

ঘুম আসেনা চোখে,
রাত পার হয়ে আসে ভোর ।
খোলা চোখে স্বপনের,
আনাগোনা কিল বিল,
কে তুমি ঘুম চোর ।

বেশী কিছু চাই,
পাবো কী সে ছাই ।
শুনেছি তুমিও নাকি,
আঁটো চোখে ঘুম যাও ।
রাত শেষে সূর্য ভোরে অলসতে তোল হাই ।

আমিও যে চাই তাই ।
ঘুম ঘুম ঘুম যাই ।
দিগন্তে যেথাভোরে,
সূর্যটা আলো ধরে ।
তারে কোন দিন,
হাত ছুঁড়ে ছুঁয়ে যাই ।

শুনেছি তুমিও নাকি,
নীল সাগরের তীরে ।
সেরেছো সকাল স্নান,
লাল ঢেউয়ে প্রাণ ভরে ।
মন চায় ছুঁয়ে দেখি ।
সে তার সে নীল আঁখি,
বল নেবে কী সঙ্গে মোরে,
নেবে কী সঙ্গে মোরে ?

কৃত্তিবাস
আগারতলা, ২৬ শে এপ্রিল ২০২০

।। এ এক অন্য ভাষা ।।

অতীতের সেই মাঠ লাগোয়া জলার ধারে ।

যখন পাতলা ফুলে সূর্য ছটা ঘুম ভাঙিয়ে যায় ।

টুপ টাপ টুপ জলের নাচন,
খরস্রোতা প্রেমের পাতায়।

অনেক আগে দাঁড়িয়ে ছিলাম,
পথের পানে নিত্য চেয়ে ।

আকাশ ফাটা সূর্য রোদে,
দুঃখ তখন আমার মেয়ে ।

মুখোমুখি হলাম যখন ।
হাত বাড়িয়ে দিলাম যখন ।
তুমি অন্য আকাশ ছেয়ে ।

বায়না তখন বিরাম পেলো ।
স্বপন দেখার দেখার নেশা ফুরোলো ।

নিজের কথায় নিজেই সয়ে ।
মাথার ওপর দিব্যি দিয়ে ।
দিন কেটেছে দীর্ঘশ্বাসের কাঁটায় ।

তার ও আগে আটকে ছিলাম
যেথায় ।
আস্তানা মোর সেই সাগরের সেথায় ।

স্বপন বুঝি সত্যি ও হয় ?
এই তো সেদিন গা ছমছম ভয় ।

এখন ও সে আশার আলো ।
শালিক ঠোঁটে বার্তা এলো ।
তারে ফিরে পেলাম শতক বোঝাপড়ায় ।

কৃত্তিবাস
আগরতলা, ২৯ শে এপ্রিল ২০২১

View my hubpages


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *